নিয়ত অনুসারে নিয়তি ও পরিণতি
عَنْ عُمَرَ بْنِ اْلَخطَّابِ رَضيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَقُوْلُ: إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَ رَ سُوْلِهِ فَهِجْرَتٌهُ إِلَى اللهِ وَ رَسُوْلِهِ، وَ مَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيا يُصِيْبُهَا أَوِامْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : কর্ম মাত্রই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। এবং প্রত্যেকের প্রাপ্য-ফল হবে তাই, যা সে নিয়ত করেছে। অতএব, কারো হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে হলে বস্তুত তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া-প্রাপ্তি অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত তারই প্রতি হয়েছে বলে গণ্য হবে।
হাদিস বর্ণনাকারী : খলিফা, আমিরুল মোমিনীন আবু হাফস উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনে নুফায়েল ইবনে আব্দুল উজ্জা আল-কোরাইশী আল-আদাবী। তিনি জন্ম লাভ করেন নবুয়্যতের ত্রিশ বৎসর পূর্বে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের প্রতি ছিলেন কঠোর মনোভাব পোষণকারী। অত:পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের কাক্সিক্ষত বিজয় ও মুক্তির দুয়ার খুলে যায়।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ র. বলেন :—
وما عبدنا الله جهرة حتى أسلم عمر.
উমর ইসলাম আনার পূর্বে আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহর এবাদত করিনি।
তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়, বিশাল অবয়ব ও রক্তিম বর্ণের অধিকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফারুক (পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা তার ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। তিনি হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সমস্ত যুদ্ধেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৩ হিজরিতে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মনোনয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা নিযুক্ত হন। তাঁর খেলাফতকালেই সিরিয়া, মিশর, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ইরাক বিজিত হয়। হিজরি সন প্রবর্তন করেন তিনিই। নথি তৈরির রীতিও তারই মাধ্যমে চালু হয়। এমনিভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের প্রচলন সর্বপ্রথম তিনিই করেছেন। মুসলিম উম্মার প্রতি তার দরদ ছিল অগাধ ; ব্যক্তিগতভাবে তিনি সকলের প্রয়োজনের প্রতি সদা দৃষ্টি রাখতেন, খুঁজে খুঁজে তাদের প্রয়োজন পূরণে তৎপর থাকতেন। সত্য ও সততায় তিনি ছিলেন কঠোর। যে পথ বেয়ে চলতেন তিনি, শয়তান তা থেকে পালিয়ে ভিন্ন পথে পলায়ন করত। দীর্ঘ দশ বছর ব্যাপী তিনি মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শাহাদাত বরণ করেন ২৩ হি: সনে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
* শাব্দিক আলোচনা :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ : এখানে আমল-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কর্ম ও কথন। বাক্যটির গঠন ও শৈলী ‘সীমাবদ্ধকরণ’ অর্থের প্রতি নির্দেশ করে। অর্থাৎ নিয়ত ব্যতীত কোন কর্মফল নেই। نية ¬-النيات এর বহুবচন ; আভিধানিক অর্থ : এরাদা, ইচ্ছা।
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ দুটি :—
এক : কর্মের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য নিরূপণ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান। অর্থাৎ, কর্মের উদ্দেশ্য কি লা-শরিক এক আল্লাহর সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অপর কারো সন্তুষ্টি, অথবা আল্লাহর সাথে সাথে ভিন্ন কেউ?—এভাবে পার্থক্য নিরূপণ। উদাহরণত: সালাত আদায়। নিয়তের মাধ্যমে সহজে আমরা পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হই যে, বান্দা তা কি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নির্দেশ পালনার্থে, তাকে ভালোবেসে, করুণা প্রাপ্তির আশায়, তার শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে সালাত আদায় করেছে, না তার আদায়ের পিছনে কাজ করেছে লোক-দেখানো, বা যশ-খ্যাতি প্রাপ্তির মত হীন উদ্দেশ্য।
দুই : এবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা। যেমন : জোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা। এবং রমজান মাসের রোজাকে অন্য মাসের রোজা থেকে পৃথক করা। অথবা এবাদতকে অভ্যাসগত নিত্য-কর্ম থেকে ভিন্ন করে নেয়া। যেমন অপবিত্রতার গোসলকে পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা।
امرئ অর্থ পুরুষ। তবে এখানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত। ইসলামি শরিয়ার প্রচলিত সম্বোধন ধারা অনুসারে অর্থাৎ ইসলামি শরিয়া কোন ক্ষেত্রে মহিলার উল্লেখ ব্যতীত শুধু পুরুষের উল্লেখ করে বিধি-নিষেধ বর্ণনা করলে, সেখানে আদৌ এ উদ্দেশ্য করা হয় না যে, বর্ণিত বিধানটি শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য, মহিলার জন্য আলাদা বিধান রয়েছে। হ্যাঁ, মহিলার জন্য আলাদা বিধান প্রমাণ করে এমন কোন দলিল যদি থাকে, তাহলে তা স্বতন্ত্র। তা উক্ত সম্বোধন ধারার আওতাভুক্ত নয়।
الهجر- هِجْرَتُهُ থেকে গৃহীত। শব্দটির আদি অর্থ—ত্যাগ বা বর্জন ; এর বিপরীত শব্দ মিলন বা সংযোগ। পরবর্তীতে এর ব্যবহার প্রাধান্য পেতে থাকে এক স্থান ত্যাগ করে ভিন্ন স্থানে গমনের ক্ষেত্রে। শরিয়তের পরিভাষায় হিজরত হল—
مفارقة دار الكفر إلى دار الإسلام خوف الفتنة، وطلبا لإقامة الدين.
দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ফেতনা হতে আত্মরক্ষার মহতী ব্রত নিয়ে দারুল কুফর ত্যাগ করে দারুল ইসলামে গমন।
دنيا দাল অক্ষরটি পেশ বা যের যুক্ত। তবে পেশ-যুক্তই অধিক প্রসিদ্ধ। অর্থ নিকটতর। পার্থিব জগৎকে দুনিয়া নামে অবহিত করা হয়েছে, কারণ, তা ধ্বংসের খুবই নিকটতর, কিংবা পরজগতের পূর্বে এই জগতের আবির্ভাব হয়েছে বিধায় তার ‘দুনিয়া’ নামকরণ করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য পার্থিব জগতের ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য-খ্যাতি ও পদবী—ইত্যাদি।
يُصِيْبُهَا অর্থাৎ তা লাভ করবে।
বিধান ও ফায়দা :—
অর্থ, মর্ম ও ব্যাপ্তির বিচারে হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ব্যাপক। নি:সন্দেহে তা দ্বীনের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। এ কারণে অনেক সালাফে সালিহীন (উত্তম পূর্ব-সুরী) এর গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন—
وبه صدر البخاري كتابه الصحييح، وأقامه مقام الخطبة له، إشارة منه إلى أن كل عمل لايراد به وجه الله فهو باطل لا ثمرة له في الدنيا ولا في الآخرة.
ইমাম বোখারি র. তাঁর কিতাব সহিহ বোখারির প্রারম্ভে ভূমিকা স্বরূপ হাদিসটির অবতারণা করে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়—এমন সকল আমল বাতিল হিসেবে পরিত্যাজ্য, এ ধরনের আমল দুনিয়া ও আখেরাতে চূড়ান্তভাবে প্রতিফলশূন্য। ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেছেন :—
هذا الحديث ثلث العلم، ويدخل في سبعين بابا من الفقه.
এ হাদিস দ্বীনের যাবতীয় উলুমের এক তৃতীয়াংশ, এবং ফিকাহ শাস্ত্রের সত্তুরটি অনুচ্ছেদে (প্রমাণ, প্রতিপাদ্য বা অন্য যে কোনভাবে) উল্লেখিত। ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন :—
أصول الإسلام على ثلاثة أحاديث:
ইসলামের ভিত্তি তিনটি হাদিসের উপর স্থাপিত।
এক : উমর রহ. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস— إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِঅর্থ : সকল আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।
দুই : আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত হাদিস :—
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
অর্থ : যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে অন্তর্ভুক্ত নয়—এমন নতুন কিছু আবিষ্কার বা সংযোজন করবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিন : নোমান ইবনে বশীর কর্তৃক বর্ণিত হাদিস : الحلال بين والحرام بين অর্থ : হালাল বিষয়ও সুস্পষ্ট, হারাম বিষয়ও সুস্পষ্ট।
মাসায়েল ও উপকারিতা :
এক : ইসলামি শরিয়তে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমল গ্রহণযোগ্য হয় না বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সকল এবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন:—
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর তাঁরই জন্য এবাদতকে বিশুদ্ধ করে। তিনি আরো বলেছেন :—
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
‘তাদের শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে খাঁটি নিয়তে আল্লাহরই এবাদত করে।’
কাজেই বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। যার সালাতের লক্ষ্য গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টি, তার নামাজ গ্রহণযোগ্য নয় কোনভাবে। অনুরূপভাবে, যার জাকাত দানের পেছনে লোক দেখানোর মত কপটাচার-কুমতলব লুকিয়ে থাকে তার সেই জাকাত আদৌ কবুল করা হবে না। এমনিভাবে কোন আমল সহিহ নিয়ত ছাড়া গৃহীত হয় না।
দুই : সালাফে সালিহীন রহ. নিয়ত বিষয়টির প্রতি অতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা তার প্রতি রাখতেন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সজাগ দৃষ্টি। গুরুত্ব ও সতর্কতা প্রমাণ করে তাদের এমন কিছু উক্তি নিম্নে পেশ করা হচ্ছে :—উমর রা. বলেছেন—
لا عمل لمن لا نية له، ولا أجر لمن لا حسبة له.
যার নিয়ত নেই, তার কোন আমল নেই।
অর্থাৎ যার কোন সওয়াবের উদ্দেশ্য নেই, তার কোন পুরস্কার নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত—
لا ينفع قول إلا بعمل، ولا عمل إلا بنية، ولا ينفع قول ولا عمل ولا نية إلا بما وافق السنة.
কর্ম ব্যতীত বাকোয়াজিতে কোন ফল নেই, আর নিয়ত ব্যতীত কর্ম অসার। কর্ম, কথা ও নিয়ত কোন কাজে আসবে না, যতক্ষণ না তা রাসূলের সুন্নতের অনুসারে করা হবে। দাউদ তাঈ রহ. বলেন :—
رأيت الخير كله إنما يجمعه حسن النية.
আমি দেখেছি, কল্যাণের সুসন্বিবেশ হয় পরিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে। ইবনে মোবারক রহ. বলেন—
رب عمل صغير تعظمه النية، ورب عمل كبير تصغره النية.
নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে, অনেক বৃহৎ আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়।
তিন : উক্ত হাদিস থেকে এ বিষয়টি সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি, সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা—প্রভৃতির ন্যায় যে কর্মগুলো স্বীয় অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে, সে সব কর্ম ও সদিচ্ছাও সৎ নিয়তের বদৌলতে পুণ্যময় কর্মে পরিণত হতে পারে। পারে পুরস্কার বয়ে আনতে এরই মধ্য দিয়ে। সুতরাং কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এবাদতের শক্তি-ক্ষমতা লাভের এরাদাও যদি করে নেয়, তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই পুরস্কৃত হবে। এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোন সু-স্বাদু বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা বন্দেগিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন, আবু যর কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকা বিষয়ক আলাপকালে বলেছেন :—
وفي بضع أحدكم صدقة، قالوا يا رسول الله أيأتي أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر ؟ قال: نعم، أرأيتم لو وضعها في حرام يكون عليها وزر ؟ قالوا : نعم، فكذلك إذا وضعها في حلال فله فيها أجر.
তোমাদের প্রত্যেকের লজ্জাস্থানে (স্ত্রী সম্ভোগে) সদকার সওয়াব রয়েছে। তখন উপস্থিত সাহাবিগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের কেউ যদি স্বীয় স্ত্রীর নিকট যৌন-চাহিদা পূরণের জন্য গমন করে তাহলে এতেও কি তার জন্য পুরস্কার আছে ? তিনি উত্তর বললেন : হাঁ, তোমরা কী মনে কর, সে যদি কোন হারাম পাত্রে তার যৌন-চাহিদা পূরণ করে তবে এতে তার পাপ হবে ? তারা জবাব দিলেন, হাঁ ! তখন তিনি বললেন, ঠিক তদ্রুপ সে যদি কোন হালাল পাত্রে নিজের যৌন-চাহিদা মেটায় তাহলে তার জন্য তাতে পুরস্কার থাকবে।
সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন:—
إنك لن تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله إلا أجرت بها، حتى ما تجعله في فيّ امرأتك.
নি:সন্দেহে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে তোমার যে কোন ব্যয়ের পরিবর্তে তুমি পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। এমনকি, পানাহার হিসাবে যা-ই তুমি নিজের স্ত্রীর মুখে দেবে তার জন্যও তুমি পুরস্কৃত হবে।
চার : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
‘সমস্ত আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং নিয়ত অনুযায়ীই প্রত্যেকের কর্মফল বিবেচিত হয়।’ এই হাদিসটি প্রমাণ করে, বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য শুধু মৌখিক স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়, বরং হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাসও একান্ত আবশ্যক। কেননা, ঈমান মৌখিক স্বীকৃতি, আত্মার বিশ্বাস এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের সমন্বয়ে গঠিত, যা আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা বৃদ্ধি এবং তার নাফরমানি দ্বারা হ্রাস পায়।
পাঁচ : উক্ত হাদিস থেকে এই ভয়ানক হুমকিও প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে যার লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়, তবে তার কৃত-কর্ম না পুরস্কার যোগ্য, না গ্রহণযোগ্য। যেমন : কেউ লোক প্রদর্শনের নিয়তে জিহাদে যোগদান করল অথবা কেউ সুনাম-সুখ্যাতি কুড়ানোর মানসে ধন-দৌলত ব্যয় করল, অথবা ‘আলেম’ উপাধি লাভের লোভে জ্ঞানার্জন করল, অথবা ‘তার কোরআন পাঠ কতই না সুন্দর’—এই প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা করল। অনুরূপভাবে তাদের ন্যায়, যাদের কর্ম-কাণ্ডের নেপথ্যে কুমতলব কিংবা কু-নিয়ত কার্যকর থাকবে, তাদের সকলের পুনরুত্থান ঘটবে নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ীই। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ ﴿১৫﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই বরবাদগ্রস্ত এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সব বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।
যে সকল মুসল্লিদের সালাতের নেপথ্যে লুক্কায়িত থাকে লোক-দেখানো ও যশ-খ্যাতির মনোভাব, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :—
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿৪﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿৫﴾ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ ﴿৬﴾ وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ ﴿
৭﴾
‘অতএব, দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে। এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না।’
ছয় : দারুল ইসলাম (ইসলামিক অঞ্চল)-এর উদ্দেশ্যে দারুল কুফর (কুফর অধ্যুষিত এলাকা) ত্যাগ একটি মহৎ কর্ম। যেহেতু দ্বীনের সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা বিষয়টির সাথে জড়িত, সেহেতু ইসলাম তার প্রতি দিয়েছে অনুপ্রেরণা, দিয়েছে জোর তাগিদ। সুতরাং হিজরতকারী যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দেয়া পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তাহলে সে উক্ত সৎকর্মের জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। আর যদি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিয়ে-শাদি, ধন-দৌলতের ন্যায় পার্থিব বস্তু হয়, তবে এমন হিজরতের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হবে না। বৈষয়িক বস্তুই হবে তার একমাত্র প্রাপ্তি।
সাত : ছোট, বড় সর্ব প্রকার পাপাচার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করাও মহান হিজরতের অন্যতম মর্ম এবং এটাই প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এভাবে তা পরিহার করতে পারলে তা তার জন্য বয়ে আনবে উত্তম বদলা। কেননা, ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু পরিহার করলে তিনি তাকে এর জন্য মহা পুরস্কার দান করেন।
-----------------------------------
১। বোখারি, মুসলিম।
২। যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৫
৩। বিনা বাধায় ইসলাম পালন করা যায় যে ভূমিতে, তাকে বলে দারুল ইসলাম ; অপরদিকে ইসলাম যেখানে অবাধ নয়, নানা প্রতিকুলতায় সীমাবদ্ধ, তাকে বলে দারুল কুফুর।
৪। বোখারি
৫। যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬
৬। মুসলিম
৭। সূরা যুমার : ২
৮। সূরা বায়্যিনাহ : ৫
৯। যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬
১০। প্রাগুক্ত : ৬
১১। প্রাগুক্ত : ৬
১২। প্রাগুক্ত : ৬
১৩। মুসলিম-১০০৬
১৪। বোখারি-৫৬
১৫।বোখারি ও মুসলিম
১৬। সূরা হুদ ১৫-১৬
১৭। সূরা মাউন ৪-৬
عَنْ عُمَرَ بْنِ اْلَخطَّابِ رَضيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَقُوْلُ: إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَ رَ سُوْلِهِ فَهِجْرَتٌهُ إِلَى اللهِ وَ رَسُوْلِهِ، وَ مَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيا يُصِيْبُهَا أَوِامْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : কর্ম মাত্রই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। এবং প্রত্যেকের প্রাপ্য-ফল হবে তাই, যা সে নিয়ত করেছে। অতএব, কারো হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে হলে বস্তুত তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া-প্রাপ্তি অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত তারই প্রতি হয়েছে বলে গণ্য হবে।
হাদিস বর্ণনাকারী : খলিফা, আমিরুল মোমিনীন আবু হাফস উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনে নুফায়েল ইবনে আব্দুল উজ্জা আল-কোরাইশী আল-আদাবী। তিনি জন্ম লাভ করেন নবুয়্যতের ত্রিশ বৎসর পূর্বে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের প্রতি ছিলেন কঠোর মনোভাব পোষণকারী। অত:পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের কাক্সিক্ষত বিজয় ও মুক্তির দুয়ার খুলে যায়।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ র. বলেন :—
وما عبدنا الله جهرة حتى أسلم عمر.
উমর ইসলাম আনার পূর্বে আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহর এবাদত করিনি।
তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়, বিশাল অবয়ব ও রক্তিম বর্ণের অধিকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফারুক (পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা তার ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। তিনি হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সমস্ত যুদ্ধেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৩ হিজরিতে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মনোনয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা নিযুক্ত হন। তাঁর খেলাফতকালেই সিরিয়া, মিশর, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ইরাক বিজিত হয়। হিজরি সন প্রবর্তন করেন তিনিই। নথি তৈরির রীতিও তারই মাধ্যমে চালু হয়। এমনিভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের প্রচলন সর্বপ্রথম তিনিই করেছেন। মুসলিম উম্মার প্রতি তার দরদ ছিল অগাধ ; ব্যক্তিগতভাবে তিনি সকলের প্রয়োজনের প্রতি সদা দৃষ্টি রাখতেন, খুঁজে খুঁজে তাদের প্রয়োজন পূরণে তৎপর থাকতেন। সত্য ও সততায় তিনি ছিলেন কঠোর। যে পথ বেয়ে চলতেন তিনি, শয়তান তা থেকে পালিয়ে ভিন্ন পথে পলায়ন করত। দীর্ঘ দশ বছর ব্যাপী তিনি মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শাহাদাত বরণ করেন ২৩ হি: সনে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
* শাব্দিক আলোচনা :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ : এখানে আমল-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কর্ম ও কথন। বাক্যটির গঠন ও শৈলী ‘সীমাবদ্ধকরণ’ অর্থের প্রতি নির্দেশ করে। অর্থাৎ নিয়ত ব্যতীত কোন কর্মফল নেই। نية ¬-النيات এর বহুবচন ; আভিধানিক অর্থ : এরাদা, ইচ্ছা।
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ দুটি :—
এক : কর্মের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য নিরূপণ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান। অর্থাৎ, কর্মের উদ্দেশ্য কি লা-শরিক এক আল্লাহর সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অপর কারো সন্তুষ্টি, অথবা আল্লাহর সাথে সাথে ভিন্ন কেউ?—এভাবে পার্থক্য নিরূপণ। উদাহরণত: সালাত আদায়। নিয়তের মাধ্যমে সহজে আমরা পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হই যে, বান্দা তা কি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নির্দেশ পালনার্থে, তাকে ভালোবেসে, করুণা প্রাপ্তির আশায়, তার শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে সালাত আদায় করেছে, না তার আদায়ের পিছনে কাজ করেছে লোক-দেখানো, বা যশ-খ্যাতি প্রাপ্তির মত হীন উদ্দেশ্য।
দুই : এবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা। যেমন : জোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা। এবং রমজান মাসের রোজাকে অন্য মাসের রোজা থেকে পৃথক করা। অথবা এবাদতকে অভ্যাসগত নিত্য-কর্ম থেকে ভিন্ন করে নেয়া। যেমন অপবিত্রতার গোসলকে পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা।
امرئ অর্থ পুরুষ। তবে এখানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত। ইসলামি শরিয়ার প্রচলিত সম্বোধন ধারা অনুসারে অর্থাৎ ইসলামি শরিয়া কোন ক্ষেত্রে মহিলার উল্লেখ ব্যতীত শুধু পুরুষের উল্লেখ করে বিধি-নিষেধ বর্ণনা করলে, সেখানে আদৌ এ উদ্দেশ্য করা হয় না যে, বর্ণিত বিধানটি শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য, মহিলার জন্য আলাদা বিধান রয়েছে। হ্যাঁ, মহিলার জন্য আলাদা বিধান প্রমাণ করে এমন কোন দলিল যদি থাকে, তাহলে তা স্বতন্ত্র। তা উক্ত সম্বোধন ধারার আওতাভুক্ত নয়।
الهجر- هِجْرَتُهُ থেকে গৃহীত। শব্দটির আদি অর্থ—ত্যাগ বা বর্জন ; এর বিপরীত শব্দ মিলন বা সংযোগ। পরবর্তীতে এর ব্যবহার প্রাধান্য পেতে থাকে এক স্থান ত্যাগ করে ভিন্ন স্থানে গমনের ক্ষেত্রে। শরিয়তের পরিভাষায় হিজরত হল—
مفارقة دار الكفر إلى دار الإسلام خوف الفتنة، وطلبا لإقامة الدين.
দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ফেতনা হতে আত্মরক্ষার মহতী ব্রত নিয়ে দারুল কুফর ত্যাগ করে দারুল ইসলামে গমন।
دنيا দাল অক্ষরটি পেশ বা যের যুক্ত। তবে পেশ-যুক্তই অধিক প্রসিদ্ধ। অর্থ নিকটতর। পার্থিব জগৎকে দুনিয়া নামে অবহিত করা হয়েছে, কারণ, তা ধ্বংসের খুবই নিকটতর, কিংবা পরজগতের পূর্বে এই জগতের আবির্ভাব হয়েছে বিধায় তার ‘দুনিয়া’ নামকরণ করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য পার্থিব জগতের ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য-খ্যাতি ও পদবী—ইত্যাদি।
يُصِيْبُهَا অর্থাৎ তা লাভ করবে।
বিধান ও ফায়দা :—
অর্থ, মর্ম ও ব্যাপ্তির বিচারে হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ব্যাপক। নি:সন্দেহে তা দ্বীনের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। এ কারণে অনেক সালাফে সালিহীন (উত্তম পূর্ব-সুরী) এর গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন—
وبه صدر البخاري كتابه الصحييح، وأقامه مقام الخطبة له، إشارة منه إلى أن كل عمل لايراد به وجه الله فهو باطل لا ثمرة له في الدنيا ولا في الآخرة.
ইমাম বোখারি র. তাঁর কিতাব সহিহ বোখারির প্রারম্ভে ভূমিকা স্বরূপ হাদিসটির অবতারণা করে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়—এমন সকল আমল বাতিল হিসেবে পরিত্যাজ্য, এ ধরনের আমল দুনিয়া ও আখেরাতে চূড়ান্তভাবে প্রতিফলশূন্য। ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেছেন :—
هذا الحديث ثلث العلم، ويدخل في سبعين بابا من الفقه.
এ হাদিস দ্বীনের যাবতীয় উলুমের এক তৃতীয়াংশ, এবং ফিকাহ শাস্ত্রের সত্তুরটি অনুচ্ছেদে (প্রমাণ, প্রতিপাদ্য বা অন্য যে কোনভাবে) উল্লেখিত। ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন :—
أصول الإسلام على ثلاثة أحاديث:
ইসলামের ভিত্তি তিনটি হাদিসের উপর স্থাপিত।
এক : উমর রহ. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস— إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِঅর্থ : সকল আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।
দুই : আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত হাদিস :—
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
অর্থ : যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে অন্তর্ভুক্ত নয়—এমন নতুন কিছু আবিষ্কার বা সংযোজন করবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিন : নোমান ইবনে বশীর কর্তৃক বর্ণিত হাদিস : الحلال بين والحرام بين অর্থ : হালাল বিষয়ও সুস্পষ্ট, হারাম বিষয়ও সুস্পষ্ট।
মাসায়েল ও উপকারিতা :
এক : ইসলামি শরিয়তে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমল গ্রহণযোগ্য হয় না বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সকল এবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন:—
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর তাঁরই জন্য এবাদতকে বিশুদ্ধ করে। তিনি আরো বলেছেন :—
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
‘তাদের শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে খাঁটি নিয়তে আল্লাহরই এবাদত করে।’
কাজেই বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। যার সালাতের লক্ষ্য গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টি, তার নামাজ গ্রহণযোগ্য নয় কোনভাবে। অনুরূপভাবে, যার জাকাত দানের পেছনে লোক দেখানোর মত কপটাচার-কুমতলব লুকিয়ে থাকে তার সেই জাকাত আদৌ কবুল করা হবে না। এমনিভাবে কোন আমল সহিহ নিয়ত ছাড়া গৃহীত হয় না।
দুই : সালাফে সালিহীন রহ. নিয়ত বিষয়টির প্রতি অতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা তার প্রতি রাখতেন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সজাগ দৃষ্টি। গুরুত্ব ও সতর্কতা প্রমাণ করে তাদের এমন কিছু উক্তি নিম্নে পেশ করা হচ্ছে :—উমর রা. বলেছেন—
لا عمل لمن لا نية له، ولا أجر لمن لا حسبة له.
যার নিয়ত নেই, তার কোন আমল নেই।
অর্থাৎ যার কোন সওয়াবের উদ্দেশ্য নেই, তার কোন পুরস্কার নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত—
لا ينفع قول إلا بعمل، ولا عمل إلا بنية، ولا ينفع قول ولا عمل ولا نية إلا بما وافق السنة.
কর্ম ব্যতীত বাকোয়াজিতে কোন ফল নেই, আর নিয়ত ব্যতীত কর্ম অসার। কর্ম, কথা ও নিয়ত কোন কাজে আসবে না, যতক্ষণ না তা রাসূলের সুন্নতের অনুসারে করা হবে। দাউদ তাঈ রহ. বলেন :—
رأيت الخير كله إنما يجمعه حسن النية.
আমি দেখেছি, কল্যাণের সুসন্বিবেশ হয় পরিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে। ইবনে মোবারক রহ. বলেন—
رب عمل صغير تعظمه النية، ورب عمل كبير تصغره النية.
নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে, অনেক বৃহৎ আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়।
তিন : উক্ত হাদিস থেকে এ বিষয়টি সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি, সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা—প্রভৃতির ন্যায় যে কর্মগুলো স্বীয় অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে, সে সব কর্ম ও সদিচ্ছাও সৎ নিয়তের বদৌলতে পুণ্যময় কর্মে পরিণত হতে পারে। পারে পুরস্কার বয়ে আনতে এরই মধ্য দিয়ে। সুতরাং কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এবাদতের শক্তি-ক্ষমতা লাভের এরাদাও যদি করে নেয়, তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই পুরস্কৃত হবে। এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোন সু-স্বাদু বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা বন্দেগিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন, আবু যর কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকা বিষয়ক আলাপকালে বলেছেন :—
وفي بضع أحدكم صدقة، قالوا يا رسول الله أيأتي أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر ؟ قال: نعم، أرأيتم لو وضعها في حرام يكون عليها وزر ؟ قالوا : نعم، فكذلك إذا وضعها في حلال فله فيها أجر.
তোমাদের প্রত্যেকের লজ্জাস্থানে (স্ত্রী সম্ভোগে) সদকার সওয়াব রয়েছে। তখন উপস্থিত সাহাবিগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের কেউ যদি স্বীয় স্ত্রীর নিকট যৌন-চাহিদা পূরণের জন্য গমন করে তাহলে এতেও কি তার জন্য পুরস্কার আছে ? তিনি উত্তর বললেন : হাঁ, তোমরা কী মনে কর, সে যদি কোন হারাম পাত্রে তার যৌন-চাহিদা পূরণ করে তবে এতে তার পাপ হবে ? তারা জবাব দিলেন, হাঁ ! তখন তিনি বললেন, ঠিক তদ্রুপ সে যদি কোন হালাল পাত্রে নিজের যৌন-চাহিদা মেটায় তাহলে তার জন্য তাতে পুরস্কার থাকবে।
সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন:—
إنك لن تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله إلا أجرت بها، حتى ما تجعله في فيّ امرأتك.
নি:সন্দেহে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে তোমার যে কোন ব্যয়ের পরিবর্তে তুমি পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। এমনকি, পানাহার হিসাবে যা-ই তুমি নিজের স্ত্রীর মুখে দেবে তার জন্যও তুমি পুরস্কৃত হবে।
চার : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
‘সমস্ত আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং নিয়ত অনুযায়ীই প্রত্যেকের কর্মফল বিবেচিত হয়।’ এই হাদিসটি প্রমাণ করে, বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য শুধু মৌখিক স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়, বরং হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাসও একান্ত আবশ্যক। কেননা, ঈমান মৌখিক স্বীকৃতি, আত্মার বিশ্বাস এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের সমন্বয়ে গঠিত, যা আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা বৃদ্ধি এবং তার নাফরমানি দ্বারা হ্রাস পায়।
পাঁচ : উক্ত হাদিস থেকে এই ভয়ানক হুমকিও প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে যার লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়, তবে তার কৃত-কর্ম না পুরস্কার যোগ্য, না গ্রহণযোগ্য। যেমন : কেউ লোক প্রদর্শনের নিয়তে জিহাদে যোগদান করল অথবা কেউ সুনাম-সুখ্যাতি কুড়ানোর মানসে ধন-দৌলত ব্যয় করল, অথবা ‘আলেম’ উপাধি লাভের লোভে জ্ঞানার্জন করল, অথবা ‘তার কোরআন পাঠ কতই না সুন্দর’—এই প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা করল। অনুরূপভাবে তাদের ন্যায়, যাদের কর্ম-কাণ্ডের নেপথ্যে কুমতলব কিংবা কু-নিয়ত কার্যকর থাকবে, তাদের সকলের পুনরুত্থান ঘটবে নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ীই। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ ﴿১৫﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই বরবাদগ্রস্ত এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সব বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।
যে সকল মুসল্লিদের সালাতের নেপথ্যে লুক্কায়িত থাকে লোক-দেখানো ও যশ-খ্যাতির মনোভাব, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :—
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿৪﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿৫﴾ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ ﴿৬﴾ وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ ﴿
৭﴾
‘অতএব, দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে। এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না।’
ছয় : দারুল ইসলাম (ইসলামিক অঞ্চল)-এর উদ্দেশ্যে দারুল কুফর (কুফর অধ্যুষিত এলাকা) ত্যাগ একটি মহৎ কর্ম। যেহেতু দ্বীনের সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা বিষয়টির সাথে জড়িত, সেহেতু ইসলাম তার প্রতি দিয়েছে অনুপ্রেরণা, দিয়েছে জোর তাগিদ। সুতরাং হিজরতকারী যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দেয়া পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তাহলে সে উক্ত সৎকর্মের জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। আর যদি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিয়ে-শাদি, ধন-দৌলতের ন্যায় পার্থিব বস্তু হয়, তবে এমন হিজরতের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হবে না। বৈষয়িক বস্তুই হবে তার একমাত্র প্রাপ্তি।
সাত : ছোট, বড় সর্ব প্রকার পাপাচার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করাও মহান হিজরতের অন্যতম মর্ম এবং এটাই প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এভাবে তা পরিহার করতে পারলে তা তার জন্য বয়ে আনবে উত্তম বদলা। কেননা, ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু পরিহার করলে তিনি তাকে এর জন্য মহা পুরস্কার দান করেন।
-----------------------------------
১। বোখারি, মুসলিম।
২। যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৫
৩। বিনা বাধায় ইসলাম পালন করা যায় যে ভূমিতে, তাকে বলে দারুল ইসলাম ; অপরদিকে ইসলাম যেখানে অবাধ নয়, নানা প্রতিকুলতায় সীমাবদ্ধ, তাকে বলে দারুল কুফুর।
৪। বোখারি
৫। যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬
৬। মুসলিম
৭। সূরা যুমার : ২
৮। সূরা বায়্যিনাহ : ৫
৯। যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬
১০। প্রাগুক্ত : ৬
১১। প্রাগুক্ত : ৬
১২। প্রাগুক্ত : ৬
১৩। মুসলিম-১০০৬
১৪। বোখারি-৫৬
১৫।বোখারি ও মুসলিম
১৬। সূরা হুদ ১৫-১৬
১৭। সূরা মাউন ৪-৬