আবু নুয়াস এর তাওবা:
আবু নুয়াস এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যে কিনা খুব মদ পান করতো এবং অশ্লীল কথাবার্তা বলতো; সে বিভিন্ন অসংলগ্ন বিষয় কল্পনা করে নিয়ে কবিতা বানাতো ও তা আবৃতি করে বেড়াতো| যাইহোক, সে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করে| মানুষজন এতে খুব অবাক হয় যে- “আবু নুয়াস? যে কিনা মাতাল হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত? যে কিনা একটা লম্পট?” এটা একরকম সবারই বিশ্বাস ছিলো যে আল্লাহ তাকে কখনই ক্ষমা করবেন না, আল্লাহ তার প্রতি করুনা করবেনই না| তাই সে নতুন একটি কবিতা রচনা করে- যেটা তার মৃত্যুর পর তার বিছানার নিচে থেকে পাওয়া যায়: কবিতার বাণী গুলোর অর্থ অনেকটা এরকম ছিলো—
“হে আমার রব, যদিও আমার পাপ অসংখ্য কিন্তু আমি জানি তোমার ক্ষমা তার চেয়েও অনেক বিশাল
যদি শুধু পুণ্যবানরাই তোমাকে ডাকে, তুমি কী অপরাধীদের ফিরিয়ে দিবে?
হে আমার রব আমি তোমার পানে চেয়ে আছি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে, যে ভাবে তুমি চেয়েছ,
এখন যদি তুমি আমায় ফিরিয়ে দাও, আর কে আছে যে আমাকে রক্ষা করবে?”
কেমন লাগছে আপনাদের?
গতকাল আমরা কথা বলেছিলাম দুটি বিষয় নিয়ে;
১: নামাজে নিজেকে একাগ্রত রাখা
২: প্রতিটা কাজ বুঝে বুঝে অন্তর থেকে অনুভব করে, চিন্তা করে করা|
আজকে, ইনশা-আল্লাহ নামাজের আরো গভীরে প্রবেশ করব| আমাদের বেশির ভাগেরই নামাজে আমরা কোন আবেগ অনুভব করিনা| যখন আমরা কোন বন্ধুর সাথে দেখা করি আমরা আনন্দ অনুভব করি, যখন কেউ দুরে চলে যায় তখন দুঃখ অনুভব করি, কেউ যখন অনেক দিন ধরে দুরে থাকে আমরা তার অভাব অনুভব করি| বন্ধুদের জন্য আমরা কতই না আবেগ আক্রান্ত হয়ে থাকি; অথচ নামাজের সময় আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করি কিন্তু আমরা কিছুই অনুভব করি না| এ কারণেই নামাজ আমাদের উপর কোন কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারছে না| তাহলে, আমাদের কী অনুভব করা উচিত? চলুন জেনে নেই|
গভীরতার তৃতীয় স্তর:
এই তৃতীয় স্তর কোনটি? ক্ষমা ও করুনা লাভের জন্য আল্লাহর কাছে আসা| এবং এই আশা করা যে ইনশা-আল্লাহ তিনি আমাদের কবুল করবেন এবং আমাদের তাঁর আরও নিকটে নিয়ে আসবেন| এই তৃতীয় স্তর টিকে বলা হয় “রযা”| যে ব্যক্তি এই ‘রযা’ অনুভব করতে পারে তার অবস্থান আল্লাহর কাছে অনেক উচুতে| কারণ এটা অন্তরের ব্যপার| হাজার মনোযোগ দিয়ে, আর বুঝে কীই বা লাভ যদি সবকিছু যান্ত্রিক হয়? নামাজের সত্যিকারের স্বাদ আহরণ তখনি সম্ভব যখন আমরা তাঁর(আল্লাহর) কাছে ‘রযা’ নিয়ে দাড়াবো|
এটা কিভাবে অর্জন করা সম্ভব?
এটা অনুভব করা সম্ভব যদি আপনি আল্লাহকে জানেন, চিনেন| আল্লাহ তায়ালাকে যতবেশী চিনবেন, তত আল্লাহর ‘রযা’ লাভ করবেন| আমাদের প্রত্যেকের প্রতি আল্লাহর করুনা আমাদের মায়ের করুনার চাইতেও অনেক অনেক বেশী| আমাদের যা করতে হবে তা হল আল্লাহর কথা বেশী বেশী স্মরণ করতে হবে, তাঁর গুনাবলী নিয়ে আলোচনা করতে হবে, চিন্তা করতে হবে, ভাবতে হবে| আমরা যা ভাববো তিনি তাই; যদি আমরা তাকে অসীম দয়ালু ও পরম করুনাময় মনে করি, তাহলে তিনি তাইই| খুবই সোজা সরল কথা-কারণ আল্লাহ তায়ালা এ কথা নিজেই বলেছেন: নবী(সা:) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা যা মনে করে আমি সে রকমই, তাই সে যেনো এমন কিছু ভাবে যাতে সে খুশি হয়|’|”
এইসব কথার মর্মার্থ নিয়ে যদি আমরা আমাদের নামাজ শুরুর ঠিক আগমুহুর্তে চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলে অবশ্যই আমাদের নামাজে তার সু-প্র্রভাব পরবে| ইবনে আল-কাইয়িম বলেছেন: “তোমার প্রতি আল্লাহর কোন ক্ষোভ নেই যে তিনি তোমাকে শাস্তি দিয়ে তার জ্বালা মিটাবেন|”
মানে আমাদের প্রতি তাঁর কোনই ক্ষোভ নেই এবং তিনি চানও না আমাদের শাস্তি দিতে| তাঁর করুনা তাঁর আযাবের চেয়ে অনেক বেশী| রহমত করাকে তিনি তাঁর নিজের করে নিয়েছেন| আল্লাহ তায়ালা বলেন-
كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَىٰ نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ
তোমাদের পালনকর্তা রহমত করা নিজ দায়িত্বে লিখে নিয়েছেন [সুরা আনআম ৬:৫৪]
সুবহান-আল্লাহ(গৌরব, অহংকার এবং মহিমা আল্লাহরই)-আমরা প্রায় সবাই বছরের পর বছর ধরে নামাজ পড়ে চলেছি অথচ কখনও আবেগ সহকারে আল্লাহর নিকটে আসতে পারিনি, তবুও তাঁর কাছে করুনা প্রার্থনা করা তিনি পছন্দ করে চলেছেন| আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:
وَاللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الشَّهَوَاتِ أَن تَمِيلُوا مَيْلًا عَظِيمًا
يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُخَفِّفَ عَنكُمْ وَخُلِقَ الْإِنسَانُ ضَعِيفًا
“হ্যাঁ, আল্লাহ তো রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান৷ কিন্তু যারা নিজেদের প্রবৃত্তির লালসার অনুসরণ করছে তারা চায় তোমরা ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দূরে চলে যাও৷আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে বিধি-নিষেধ হাল্কা করতে চান৷ কারণ মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে৷” [সুরা নিসা ৪:২৭-২৮]
এর পরের নামাজে এই পন্থা প্রয়োগ করে দেখুন
নিজের মন থেকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করুন যে আল্লাহতায়ালা আপনাকে ক্ষমা করে দিতে চান, মার্জনা করে দিতে চান এবং আপনার প্রতি করুনা বর্ষণ করতে চান| বিশ্বাস করুন এবং মনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করুন যেনো তিনি আপনাকে জান্নাতুল ফিরদাউস করেন, এবং শুধু তাইই না, আপনি যেনো জান্নাতে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিবেশী হোন| এগুলো আকাশচুম্বী কল্পনাপ্রসূত কোন গল্প নয়| বরং আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। [সুরা গাফির ৪০:৬০]
নবী(সা:) বলেন: “আল্লাহর কাছ থেকে নিশ্চয়তার সাথে প্রার্থনা করো|” যদি আপনি তা করেন; আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তার থেকেও অনেক বেশী দান করবেন| কিন্তু মনে রাখবেন এসব চাইতে হবে ‘রযা’ অবস্থায় “আমানি” অবস্থায় না| পার্থক্য কোথায়?
‘রযা’ হল এতক্ষণ ধরে যা বলা হল তা সব, কিন্তু এসব করতে একাগ্র চিত্তে ও পরিশ্রমের মাধ্যমে; একবারে না হলে পুনরায় চেষ্টা করতে হবে, চাইতে হবে আল্লাহর কাছে তিনি যেনো আপনার জন্য ‘রযা’ পাওয়াকে সহজ করে দেন, যদি তা না করি তাহলে সেটা হল ‘আমানি’..সঠিক একাগ্রতা আর অধ্যাবসায় ছাড়া এমনি এমনি আল্লাহর করুনা প্রার্থনা করা- তিনি(আল্লাহ) তা করা পছন্দ করেন না| আল্লাহতায়ালা বলেন:
وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِّمَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ
আর যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল।
[সুরা তাহা ২০:৮২]
আর এমন করলেই তিনি আপনাকে আপনার প্রতাশার চাইতেও বেশী কিছু দান করবেন|
আল্লাহর করুনা:
আল্লাহ তাঁর করুণাকে ৯৯ ভাগে ভাগ করেছেন, এবং তার মাত্র একটি ভাগ তিনি সমগ্র পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন| এই এক ভাগই এত শক্তিশালী যে তা সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মায়েদের, বাবাদের, সন্তানদের, স্বামীদের, স্ত্রীদের এমনকি সকল পশু প্রানীদের মাঝে এমন ভাবে বিদ্যমান- যে সন্তান যতই যা করুক মা তাঁর সন্তানের একটু কষ্ট দেখলে কী যন্ত্রনাই না পায়; কোন বাবা তার সন্তানের জন্য কত কী না করেন; জন্ম দেয়ার পর মা কিভাবে আগলে রাখে তার সন্তান দের....আরো কত...|আরেকটি উদাহরন দেই-নিজের জন্মের আগের অবস্থা কল্পনা করুন – কিছুই ছিলেন না আপনি, নয় মাস মায়ের পেটে থেকে মাকে ব্যথা দিয়েছেন, এত কষ্ট দিয়েও ক্ষান্ত হননি, পৃথিবীতে আসার মুহূর্তেও মাকে দিয়েছেন কী অসম্ভব কষ্ট, কী পরিমান কষ্ট সয্য আপনার মা আপনাকে জন্ম দিলেন অথচ জন্মের পরপরই আপনিই হয়ে গেলেন তার নয়নমনি, আদরের ধন ...একবার কী চিন্তা করেছেন আপনি কী এমন করেছিলেন যে আপনি আপনার মার এত ভালোবাসা, দয়া, করুনার পাত্র হয়ে গেলেন? এসবি যদি সেই একটি ভাগেরই অংশ হয়ে থাকে তবে বাকি ৯৯ ভাগের কথা কী কল্পনা করা সম্ভব? কখনই না ..তার করুনা অসীম; শেষ বিচারের দিন তিনি যখন এই সমগ্র করুনা নিয়ে আমাদের বিচার করবেন তখন কী অবস্থা হতে পারে? এটা কী আমাদের আবৃত না করে পারবে? আমাদের চেয়ে অনেক পাপী মানুষ যাদের আল্লাহ তাঁর স্বীয় করুনায় ক্ষমা করে দিয়েছেন, যেমন সেই মানুষটি যে ৯৯জনকে হত্যা করেছিলো তারপর আরও একজন কে হত্যা করে ১০০ পুরো করছিলো আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন | তাহলে কিভাবে তিনি আমাদের ক্ষমা ও করুনা না করে থাকতে পারেন?
তাহলে আপনি আমি কী তাঁর অসীম করুনার ভাগিদার হতে পারিনা? অবশ্যই পারি| চলুন তাহলে আজ থেকেই এভাবে নামাজ পড়ি ও প্রার্থনা করি|
[চলবে.....(ইনশা-আল্লাহ)]
No comments:
Post a Comment